দুইশ ছ'রাত ধরে শয্যাশায়ী আব্দুল গণি সাহেবের বয়স প্রায় অর্ধশত বছর! এই বয়সেই তার গাল নেমে এসেছে গলার কাছে। সেই গালে কালো দাড়ির অধিকাংশই আবার অভিজ্ঞতার রঙ সাদা হয়ে গেছে। ঊহুদ পাহাড়ের মতো উঁচু নাকের নীচের গোঁফ ছোট করে ছাঁটা। মাথার চুলের এমন মহামারি যে গুনলে চুলের সংখ্যার একটা হিসেব দাঁড় করানো যাবে। গাত্রবর্ণ কৃষ্ণকালো, এই কালো রঙকেই বোধ হয় সাহিত্যের ভাষায় বলে 'কাক চক্ষুজল'!
এই মুহূর্তে আধোজাগরণে থেকে তার মনে হচ্ছে তিনি মারা যাচ্ছেন। অথচ, কি তুচ্ছ একটা ঘটনা নিয়েই না তার মস্কিষ্ক আঁটকে আছে। আজ থেকে প্রায় পাঁচ দশক আগে তার জন্ম হয় নিতান্তই একটা দরিদ্র পরিবারে। সেই পরিবারের প্রধাণ আব্দুল গণির বাবা মাওলানা মতিউদ্দিন কেন এরকম অভাবের সংসারে জন্মানোর পরেও নিজের নবম সন্তানের নাম 'আব্দুল গণি' রাখলেন সেটা আব্দুল গণির কাছে বিশাল রহস্য! কারণ 'গণি' শব্দের অর্থ ধনী। অথচ, তার জন্মের পরেও তার মা রোজ দু'বেলা ভাতের মাড় খুঁজে আনতেন তাদের নয় ভাইবোনের বিশাল আহার জোগানের জন্যে। তবুও বেশিরভাগ দিনই তারা কাটিয়েছেন অনাহারে কিংবা অর্ধাহারে! তাদের ঘরে তৈজসপত্র বলতে ভাতের কয়েকটা হাঁড়ি-পাতিল আর দু'টা খাট! তবুও কেন তার নাম 'গণি'!?
মানুষের মৃত্যুর পর যে সাত মিনিট পর্যন্ত মস্তিষ্কে সারা জীবনের স্মৃতি পুনরায় নাড়া দিয়ে ওঠে, সেই বৈজ্ঞানিক তথ্য আব্দুল গণির জানা আছে। এজন্য তিনি এখন আরো সন্দিহান। কারণ, এতবছর পর তার মাথায় এখন ফেলে আসা জীবনের স্মৃতির পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। কিন্তু, মারা গেলে পাশে শুয়ে থাকা তার স্ত্রীর গভীর ঘুমের নিঃশ্বাসের শব্দও শুনতে পাবেন কেন?
নিঃশ্বাসের এই শব্দ যেন কিশোর বয়সে বর্ষার ভোরের লিলুয়া বাতাসের সেই শব্দ। আহারে...! ছবির মতো পরিষ্কার সেই দৃশ্য! ওইতো গলা সমান থৈ-থৈ পানিতে মাথা উঁচু করে ফুটে আছে শয়ে-শয়ে শাপলা। এই ফুল উঠিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ওলিপুর হাটে নিয়ে যাওয়া যাবে; ততো বেশি দাম পাওয়া যাবে। শাপলা বেচার টাকা দিয়ে হাশেম মোল্লা থেকে এক ছটাক কেরোসিন কেনা যাবে। চারদিন পর হারিকেনে আলো জ্বলবে, সেই আলো ঘিরে সব ভাইবোনেরা পড়তে বসবে। মাস্টার হিসেবে থাকবে আব্দুল গণির পিতা যার একমাত্র কাজ হচ্ছে ছেলেদের বাংলা উচ্চারণে ভুল হলে বেত গাছের ডাল দিয়ে বেতাঘাত করা কিংবা মাগরিব থেকে এশা পর্যন্ত তার গা টেপা।
মাত্র তের বছর বয়সে কলেরায় মারা যাওয়া তার সেজো বোনের আঁচলের ভেতর থেকেও বের হয়ে আসা হারিকেনের আঁধো-আলোতে দেখা অবাধ্য সোনাকেশী চুলের সৌন্দর্যের রূপ কি গণি সাহেব তার পরবর্তী জীবনে কখনো দেখেছেন!? নাহ্ মনে পড়ছে না তার। বরং তার কানে ভাসে দু'টা বাতাসার লোভে মক্তবে গিয়ে আলিফ দুই যবর আন, বা দুই যবর বান, তা দুই যবর তান সমস্বরে উচ্চারিত সেই শব্দ! উথালপাথাল করা কালবৈশাখি ঝড়ে মিজি বাড়ির বাগানে আমকুড়ানো দুপুর। কনকনে শীতে খেজুরের রসের স্বাদ এখনো জিভকে যেন মধুতে ভেজায়।
ভরপূর্ণিমার রাতে এক হাতে কোঁচ আর অন্য হাতে দোনালী নিয়ে চোখে মাছ শিকারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সাথে নৌকা লয়ে ভেসে যাওয়া অথৈ জলের ওপর ভাসে। যেন জীবন ভেসে যায় যেভাবে। ক্ষাণিকপর নৌকার মাচালিতে বসে আকাশ দেখা! উপরে শূন্য আকাশে ঝুলে থাকা নির্জন বিমিশ্র একটা চাঁদ। নিচে কালো রঙের জল, জ্যোৎস্না মেখে চিকচিক করছে। নৌকা ভীড়ে তার বাড়ির পাশে এসে। দোনালির ধোঁয়ায় শাণিত হয় চারপাশ। জৈবনিক ক্লান্তি সেই ধোঁয়ায় উড়িয়ে কাঁধের উপর থেকে ঝেড়ে নেয় তার পরবর্তী জীবনের সমস্ত পাপ। পবিত্র হয় জড়তা থেকে; তারপর বন্ধ চোখ নিকষ কালো অন্ধকার ডেকে আনে। এইতো জীবন, শেষ জীবন!
নাহ্, এভাবে আর কতক্ষণ!? তার খুব করে জানতে ইচ্ছে করছে সে বেঁচে আছে নাকি নেই! তার নিথর দেহের মগজে আবারো প্রশ্ন জাগলো মৃত্যুদন্ড বড় স্বাস্তি নাকি সুনিশ্চিত মৃত্যু জেনে সেই মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষার প্রহর গুনা বড় স্বাস্তি!? একথা ভাবতে-ভাবতেই আব্দুল গনির মনে হয় আগামি কালই তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে হবে সদ্য ক্যালেফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি নেয়া মাসরুরের সাথে। আহা, ছেলেটার সাথে এখনো কথা হলো না! গত সপ্তাহে কেনা জার্মান লেখক 'প্যাট্রিক সাসকাইন্ডের' পঁতাল্লিশটি ভাষায় অনু্বাদিত লেখা 'পারফিউম' সেই বিখ্যাত উপন্যাসটিও এখনো পড়া হয় নি! বাবা মায়ের কবর যিয়ারতে যেতে পারে নি দুই বছর!
ওদিকে ক্ষীণ স্বরে কে যেন বলে, আহা! ভিতরে কর্পূর দিয়ে কফিনের শেষ পেরেকটা ঠুকে দাও না! কি আশ্চর্য তিঁনি কি বেঁচে আছেন নাকি নেই!? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে-খুঁজতে, দীর্ঘ আঠারো বছর ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করা আব্দুল গণি এই গ্রহে ফুসফুস ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাইলেন। আরো একবার, শেষবার!
মুহাম্মদ ফয়সাল আরফিন শান্ত
Comments
Post a Comment